বাঙালী ‘কমলা ভট্টাচার্য’ বিশ্বের প্রথম নারী ভাষাশহীদ

https://taramonbd.com/wp-content/uploads/2019/08/bangla-1280x720.png

১৯৬১ সালের ১৯ই মে প্রথম প্রহর, রাত বারোটা। ভারতের আসাম প্রদেশের শীলচর রেলওয়ে স্টেশন। এত রাতেও প্রচুর নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছেন। সময় যত গড়াচ্ছে মানুষের সংখ্যা ততই বাড়ছে। মধ্যরাত পেরিয়ে সকাল হল, সকাল গড়িয়ে দুপুর। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে ততক্ষণে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এক রকম আসাম।
পুলিশ রাইফেল, টিয়ারগ্যাস নিয়ে প্রস্তুত। সমবেত নারী পুরুষদের ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’ স্লোগানে মুখরিত আকাশ বাতাস। তাদের একটাই দাবি, বাংলাভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি। বাংলাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত অসমীয়া ভাষার (আসাম প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা) সমমর্যাদা দেয়া না হবে আইন সংশোধন করে ততদিন তারা এ মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। হাজার দশেক নারী পুরুষের এ অহিংস অবস্থান থেকে কোনভাবেই তাদের টলানো যাচ্ছেনা। অবশেষে অধৈর্য প্রশাসন প্রথমে টিয়ারগ্যাস ও পরে গুলি চালালো। সমবেত জনতাকে তবুও ছত্রভঙ্গ করা যাচ্ছেনা। উপরন্তু দৃপ্ত ভঙ্গীতে এগিয়ে আসা মিছিলে গুলি চালালে লুটিয়ে পড়লেন ১১ জন। কমলা ভট্টাচার্য নামের এক ষোড়শী তরুণীও ঢলে পড়ল গুলিতে। তারা রক্তে রঞ্জিত হল শীল চরের রাজপথ। জনতা এতে আরও ক্ষিপ্র হল, পুলিশ পিছু হটল, তবু জনতা রাস্তা ছাড়ল না। কিন্তু কমলাকে বাঁচানো গেলনা। এই কমলাই হল বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ। তবে বাংলাদেশের নয়, বাংলাদেশের কাছেই, আসামে।
এর মাত্র নয় বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষেরা যেভাবে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে জীবন দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই আসামেও ঐ একই বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রক্ত ঝরল। নিঃসন্দেহে আসামের বাঙ্গালীরা পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তবে আসামে বাংলা ভাষাকে রাজ্য ভাষার দাবি করা হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। এবং মজার ব্যাপার হল প্রায় একযুগের আন্দোলনের পরে এই আন্দোলনের দরুনই বাংলাভাষা শুধু আসামের রাজ্য ভাষা হিসেবেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রধান ভাষা ও কেন্দ্র মানে পুরো ভারতবর্ষের প্রধান ৫টি ভাষার একটি হিসেবেও মর্যাদা পায় রাষ্ট্রীয়ভাবে। বাংলা ভাষার জন্য এই দুবার পৃথিবীর দুই দেশে রক্ত ঝরল যা অন্য কোন ভাষার ক্ষেত্রে হয়নি , তাই বাংলা ভাষার ইতিহাসে এ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
মূল ঘটনা
আন্দোলন এর উদ্ভব দেশবিভাগের পর। আসামের হাইলাকান্দি, শিলচর ও করিমগঞ্জে গড়ে ওঠা বাঙ্গালি জনপদ থেকেই মূলত এ আন্দোলনের সূত্রপাত। কেননা, এসব অঞ্চলে ১৯৪৭ এ পূর্ব বাংলা থেকে আসা বাঙ্গালিরা আসামের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অসমীয়ায় অসমীয়া জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়ে ওঠে। আর এরই ফলশ্রুতিতে শুরু হয় ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। বাঙ্গালীরা এর প্রতিবাদ সরূপ মাতৃভাষা বাংলাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু করে, কারণ বাংলা ভাষা স্বীকৃতি না পেলে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীও আসামে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত থেকে যাবে। তাই আসামের রাজ্য ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি দাবির এ আন্দোলন হয়ে উঠেছিল বাঙ্গালী সমাজের অস্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার।
 ১৯৬০ সালের ৩রা মার্চ  আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা চালিহা আসামের বিধানসভায় ঘোষণা করেন আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা হবে অসমীয়া। ঐ বছর ১০ই অক্টোবরে বিধানসভায় সে অনুযায়ী আইনও প্রণয়ন করা হয়। এই ঘোষণা ও আইনের প্রতিবাদে ফেটে পরে আসামের বাঙ্গালী সমাজ। বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে বাংলা ভাষাভাষীদের নাগরিক সভা একটি আন্দোলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে, এ কমিটির আহবায়ক করা হয় অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথকে। বিধানসভার আইনের প্রতিবাদে পণ্ডিত রামমোহন নাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর বাংলা ভাষাভাষীরা বাংলাকে রাজ্যভাষা করার দাবিতে অহিংস আন্দোলনের উদ্দেশ্য শীল চরের রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি সম্মেলন আয়োজন করে। ১৯ নভেম্বর এই সম্মেলনেই আসামের পুলিশ গুলি চালায়। নারী-পুরুষ-কিশোর-কিশোরী-ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে এই সম্মেলনে যোগদান করেছিল হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের গুলিতে ঝরে পড়ে ১১ টি তাজা প্রাণ। তার মধ্যে ছিল সদ্য মেট্রিকুলেশন শেষ করা কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য একজন। 
জানা যায়, মৃত্যুর পর  মেয়ের মেট্রিকুলেশন এর প্রকাশিত ফলাফল নিয়ে বিধবা মা আর্তনাদ করে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের মত স্বাধীন দেশের মানুষের হাতেই প্রাণ যাবে গো তোমার সন্তানের।’ 
টনক নড়ল দিল্লীর কেন্দ্র সরকারের। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর দেয়া সূত্রের ভিত্তিতে আসাম বিধান সভার প্রণয়ণকৃত আইন সংশোধন করা হল, স্বীকৃতি দেয়া হল বাংলা ভাষাকে, শুধু আসামে নয়, কেন্দ্রের প্রধান ৫টি রাজ্যভাষার একটি হল বাংলা।
কমলা ভট্টাচার্যের পরিচয়
কমলা ভট্টাচার্য এ ভূমিরই সন্তান। জন্ম সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে, ১৯৪৫ সালে। ১৯৫০ সালে সিলেটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শতাধিক হিন্দু নিহত হয়। দাঙ্গার ভেতরেই তারা নিকটবর্তী আসাম প্রদেশের কাছাড় জেলার শীল চরে আশ্রয় নেন। কমলার বাবা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবী। শীলচরের পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। শৈশবেই বাবাকে হারান কমলা। কমলা ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে পড়তেন। তিন ভাই ও চারবোনের বড় সংসারে অভাব অনটন নিত্য দিনের সাথী। কমলা ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন পঞ্চম।
সংগ্রামের দিনগুলি
একমাত্র স্কুলশিক্ষক চাকরিজীবী মেজ বোন প্রতিভার আয়ে তাদের সংসার চলত। স্কুলের বই কেনার সামর্থ্য ছিল না, তাই কমলা অন্য সহপাঠীদের বই থেকে নোট টুকে নিয়ে পড়ত। লড়াকু মেধাবী কমলা অভাব সত্ত্বেও মেট্রিকুলেশন শেষে স্নাতকোত্তর পড়বে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু এর মধ্যেই চলে এলো ভাষা আন্দোলন। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরের দিনই ১৮ নভেম্বরই স্কুলের ২২ জনের সহপাঠীদের একটি দলের সাথে কমলা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলনে।  ১৯ নভেম্বর সম্মেলনের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন সমাবেশের ভেতর। পুলিশ এর গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যাওয়ায়, পুরো মস্তিষ্ক বের হয়ে পরে। তার ছোট বোন ১১ বছরের মঙ্গলাও অংশগ্রহণ করেছিল সমাবেশে। মঙ্গলাও পুলিশের লাঠির আঘাত পান। তবে বোনের নির্মম মৃত্যু চোখের সামনে দেখে মানসিক ভারসাম্য হারান। সারাজীবনের জন্য তাকে শারীরিক ও মানসিক পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়।
রয়ে গেলেন পরিচিতির অন্তরালে
বাংলা ভাষার জন্য রফিক-শফিক-সালাম-বরকত-জব্বারকে আমরা যেভাবে স্মরণ করি, প্রজন্ম তাদের যেভাবে চেনে, কমলা এবং সেদিন যারা আরও প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরা রয়ে গেছে ঠিক সেভাবেই অপরিচিত এবং স্মরণের অন্তরালে। অথচ পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের অবদানকেও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। একমাত্র নারী শহিদ কমলা ভট্টাচার্যকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশেও। শীলচর রেলওয়ে স্টেশনের শহীদ বেদীর উপর কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তি ও একটি ব্রোঞ্জ ফলক করা হয়েছে তাঁদের স্মরণে। এছাড়া ২০১১ সালে কমলার স্কুল ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। এছাড়া পাবলিক স্কুল রোদের পুনর্নামকরণ করে করা হয় কমলা ভট্টাচার্য রোড নামে। এখনও ২১ শে ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি ১৯ নভেম্বরও ভাষা শহীদ দিবস পালন করে আসাম।
১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ভাষা শহীদ ১১ জনের তালিকা –
 ১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী
৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ
১০. শহীদ সুনীল সরকার
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, উন্নয়ন বা প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন সবার কথাই জানতে হবে, শ্রদ্ধা করতে হবে। তাই বাংলা ভাষার জন্য কমলাসহ ঐ ১১ জনের কথাও জানতে ও জানাতে হবে। আমাদের জাতিসত্তার আত্ম পরিচয় সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সব লড়াইয়ে নারীরা শুরু থেকেই সংযুক্ত ছিলেন, অবদান রেখে গেছে সক্রিয়ভাবে, সেই প্রীতিলতা থেকে বেগম রোকেয়া ও কমলা ভট্টাচার্য, তারামন বিবি প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ, প্রেরণাদায়ক যোদ্ধা ব্যক্তিত্ব।
তথ্যসূত্রঃ
* বিশ্বাস, সুকুমার। আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি-প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১। আগরতলা, ত্রিপুরা: পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড
* ভোরের কাগজ,  দ্যা ডেইলি স্টার, উইকিপিডিয়া, জাগরনীয়া


Post a Comment

0 Comments