বঙ্গদেশের অষ্টধা কালী আদি শক্তি রূপে যোগীদের মন্ত্র ও তন্ত্র উদঘাটনে তত্‍পর।


অষ্টধা কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালী আদি শক্তি রূপে যোগীদের মন্ত্র ও তন্ত্র উদঘাটনে তত্‍পর। কালী দশমহাবিদ্যার প্রথমা দেবী ও বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। পরমানন্দা সত্ত্ববিদ্যাধারিণী জগন্ময়ী রূপ তাঁর। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের নির্গমন হয় এবং জীবের ক্রমবিকাশ হয় তেমনই সেই সব সৃজনই তাঁর সৃষ্টিশক্তি।

তান্ত্রিক মতে কালী 'অষ্টধা' বা 'অষ্টবিধ'। এই 'অষ্টধা' হলেন -- দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুন্ডাকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী।

১) দক্ষিণাকালী --

অষ্টধা কালী প্রথম কালী রূপটি হলো দক্ষিণাকালী। দক্ষিণাকালী কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি। দেবীর প্রচলিত ভাষায় ন শ্যামাকালী। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। দেবীর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুলে বর ও অভয় মুদ্রা। দেবীর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। দেবীর গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। দেবীর দন্ত ভয়ানক; তাঁর স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। দেবীর চতুর্দিকে শ্মশানে শিবাবাহিনী ঘোর রবে দেবীর জয়ধ্বনি করছেন। দক্ষিণ দিকের অধিপতি যম এই দেবীর নাম শুনে পলায়ন করেন, তাই ইঁনি দক্ষিণা কালী। এই দেবীর উপাসক দের যম ভয় থাকে না। দক্ষিণাকালীর পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়।

২) সিদ্ধকালী --

সিদ্ধকালী দ্বিভুজা। সিদ্ধকালী তার দক্ষিণের হস্তের খড়গ দ্বারা চন্দ্রমণ্ডল ভেদন করছেন। সেই চন্দ্র মণ্ডলের গলিত রস দেবীর সর্বাঙ্গ প্লাবিত করছে। তিনি বাম হস্তের কপাল পাত্রে ঐ অমৃত ধারন করে পান করছেন। দেবী ত্রিনয়নী, মুক্তকেশী, দিগম্বরা। দেবীর কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ। শিরে মনি মুক্ত খচিত মুকুট। দেবী দীপ্তজীহবা, দেবীর তনু কান্তি নীলোৎপল সদৃশ। কর্ণে তার রবি শশী তুল্য সমুজ্জ্বল কুন্ডল দ্বয়। দেবী মহাদেবের বুকে বাম চরণ স্থাপন করে আছেন, দক্ষিণ চরণ পেছনে। সিদ্ধকালী কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা। গৃহস্থ ব্যাক্তিরা দেবীর পূজো করেন না ।

৩) গুহ্যকালী --

গুহ্যকালী মহামেঘপ্রভা, কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেন, লোলজিহ্বা, ঘোর দ্রংষ্ট্রা, কোটাক্ষী, হসন্মুখী। দেবীর কন্ঠে নাগ হার। ত্রিনেত্রা দেবীর মস্তকের গগনচুম্বী জটাজালে অর্ধচন্দ্র। দেবী শব আস্বাদনে আসক্তা। গুহ্যকালী নাগ যজ্ঞপবীত ধারন করেন, নাগশয্যেপরি বিরাজিতা। দেবীর কন্ঠদেশে পঞ্চাশৎ মুন্ড সংযুক্ত বনমালা, দেবী মহোদরী। সহস্র ফনা যুক্ত অনন্ত নাগ দেবীর শিরোপরি দেবীর চতুর্দিকে নাগ গণ ফণা তুলে বেষ্টন করে থাকেন। সর্পরাজ তক্ষক দেবীর বাম হস্তের কঙ্কণ এবং অনন্ত নাগ দক্ষিণ হস্তের কঙ্কণ। দেবী নাগ নির্মিত কাঞ্চী ও রত্ন নূপুর ধারন করেন। দেবীর বাম দিকে শিব সব্রুপ কল্পিত বৎস্য থাকে। দেবী দ্বিভুজা, দুইহাতে বরাভয় মুদ্রা। দেবীর শ্রুতি দ্বয় নরদেহসমাবদ্ধ কুন্ডল দ্বারা শোভিত থাকে। দেবী প্রসন্ন বদনা, সৌম্যা, নারদাদি মুনি গণ সেবিতা। অট্টহাস্যকারিনী এই দেবী সাধক দের অভিষ্ট দায়িনী। গুহ্যকালীর পূজো গৃহস্থ বাড়িতে হয় না। দেবী কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা। তবে কিছু পণ্ডিত এর মতে গ্রহ দোষ কাটানোর জন্য গৃহস্থ বাড়ীতে এই মায়ের পূজো করা যেতে পারে।

৪) শ্রীকালী --

শ্রীকালী মহাদেবের শরীরে প্রবেশ পূর্বক মহাদবের কন্ঠে স্থিত গরলে নিজ তনু কৃষ্ণ বর্ণ করেছেন। মহাদেবের ন্যায় শ্রীকালী ত্রিশূল ধারিনী, শ্রীকরে সর্প বলয় যুক্তা। লিঙ্গ পুরান মতে শ্রীকালী দারুক নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন । একারণে দেবীকে দারুকাসুর মর্দিনী কালীও বলা হয়।

৫) ভদ্রকালী --

তন্ত্র মতে ভদ্রকালী ক্ষুধায় ক্ষীণা। কোটোরাক্ষী, মসিমলিনমুখী, মুক্তকেশী। ভদ্রকালীর কর দ্বয়ে জ্বলন্ত অনল শিখার ন্যায় দীপ্ত পাশ যুগ্ম থাকে। দেবী পুরাণ বলেন – দেবী অন্তিমে মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল বিধান করেন, তাই তিনি ভদ্রকালী। কালিকাপুরাণ মতে ভদ্রকালী অতীব সুন্দর। অতসীপুস্পের ন্যায় গাত্র বর্ণ, মস্তকে জটায় উজ্জ্বল মুকুট, ললাটে অর্ধ চন্দ্র, কন্ঠে উজ্জ্বল নানা হার- নাগহার। অস্ত্রাদি দ্বারা সজ্জিত এই দেবীর পদতলে বাহন পশুরাজ থাকেন, দেবী বাম চরণে মহিষকে চেপে তাহাকে বধ করেন। দেবী এমন ভয়ঙ্করী রূপ হলেও অমঙ্গল ও ভয়-ভীতি হরণ করেন। ভদ্রকালীর পূজো গৃহস্থ ও সাধক উভয়েই করতে পারেন।

৬) চামুন্ডাকালী --

শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব দেবী কৌষিকীর সাথে যুদ্ধ করতে আসলে দেবী তার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করেন। সেখানে থেকেই দেবী চামুন্ডার আবির্ভাব হয়। ভয়ঙ্করী এই চামুন্ডাকালীর মূর্তি। চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব কে বধ করার জন্য তিনি চামুন্ডা নামে খ্যাত হন। কালিকাপুরাণে এই চামুন্ডাকালী দেবীকে নীল পদ্মের ন্যায়, চতুর্ভুজা বলা হয়েছে। তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী, নরমুণ্ড মালিনী, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা। অতি ভীষনা, বিশাল বদনা, লোলজিহ্বা, ভয়ঙ্করী, কোটর গতা, আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী। চামুন্ডাকালী মাতা শব বাহনা। দুর্গাপূজার সময় সন্ধিক্ষণে এই দেবীর পূজা করা হয়। চামুন্ডাকালীর পূজো কেবল সাধক দের জন্যই। গৃহস্থ বাড়ীতে বা গৃহস্থ লোকেরা এই দেবীর পূজো করেন না।

৭) শ্মশানকালী --

শ্মশানকালী ঘন কৃষ্ণবর্ণা, শ্মশান বাসিনী, রক্তবর্ণ নেত্র, মুক্তকেশী, শুস্কমাংসা, অতি ভৈরবা, পিঙ্গল নয়না, কারণ- মাংস পূর্ণ পাত্র ধারিনী ও ভক্ষণকারিণী, ডান হস্তে নর মুণ্ড, বাম হস্তে পান পাত্র। দেবী স্মিতবক্ত্রা, সর্বদা আমমাংস চর্বণ তৎপরা, নগ্না, সদা মদ্যপানে প্রমত্তা। দেবী অতি উজ্জ্বল অলঙ্কার ধারিনী। পূর্বে ডাকাতেরা এই দেবীর কাছে পূজা দিয়ে ডাকাতি করতে যেতো। তন্ত্র সাধকেরা বীরাচারে এই দেবীর আরাধনা করেন। শ্মশানে এই দেবীর পূজা হয়। গৃহস্থ বাড়ীতে এই দেবীর পূজা বা ছবি রাখা হয় না।

৮) মহাকালী --

তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মহাকালী পঞ্চদশ নয়না, মহারৌদ্রী। দেবীর হাতে শক্তি, শূল, ধনু, বাণ, খড়গ, খেটক, বর ও অভয় থাকে। মার্কণ্ড পুরাণে এই দেবীর বর্ণনা আছে। সৃষ্টির আদিতে ভগবান বিষ্ণুর কর্ণমলজাত মধু ও কৈটভ নামক দুই দানব প্রজাপতি ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত হলে, ব্রহ্মা তখন যোগনিদ্রায় মগ্ন হরিকে স্তব করেন। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু তখন যোগনিদ্রার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন দেখে ব্রহ্মা তখন হরিনেত্রনিবাসিনী সেই দেবীর স্তব করলেন। ব্রহ্মার স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবী , মহাকালী রূপে প্রকট হলেন। যোগনিদ্রা থেকে মুক্ত হয়ে ভগবান বিষ্ণু ঐ দুই দানবকে বধ করেন। এই দেবীর দশ মুখ, দশ হাত, দশ চরণ। তনু নীলকান্ত মণির মতো উজ্জ্বল। ত্রিনয়না দেবী খড়্গ, বাণ, ধনুক, শঙ্খ, চক্র, ত্রিশূল, গদা, পরিঘ- ভূষ্ণণ্ডী, নরমুণ্ড ধারন করে আছেন। কেবল সাধক রাই মহাকালীর পূজো করতে পারেন। কথিত আছে দেবী প্রথমে সাধককে নানা ভাবে ভয় দেখান। সাধক ভয় তুচ্ছ করে সাধনার পরীক্ষায় সফল হলে দেবী নানা রকম সিদ্ধি দান করেন।

.

ॐ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।

সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।
গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্তুতে।।

শরণাগতদীনার্ত-পরিত্রাণপরায়ণে
সর্বস্যার্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।

জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দূর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে।।

ॐ কালি কালি মহাকালি কালিকে পরমেশ্বরি।
সর্বানন্দকরে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে।।

Post a Comment

0 Comments