বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলার প্রতিবাদে-নিন্দায়-ক্ষোভে উত্তাল সিডনি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ৯-দফা দাবি।

বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলার প্রতিবাদে-নিন্দায়-ক্ষোভে উত্তাল সিডনি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ৯-দফা দাবি।

আন্তর্জাতিক ডেস্ক-  গত সপ্তাহে দুর্গা পূজা চলাকালীন বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর ইসলামী মৌলবাদীদের বর্বরতম হামলার প্রতিবাদে ২৪ অক্টোবর বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার প্রধান শহর সিডনি। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিক্ষুব্ধ সদস্যসহ সকল সম্প্রদায়ের জনগণ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ২৬টি সংগঠনের প্রতিনিধি, অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিবিদ, অস্ট্রেলিয়ান সরকারের মিডিয়া এসবিএস এবং বাংলাদেশি কমিউনিটির মিডিয়াসহ বিপুল সংখ্যক জনতা এই প্রতিবাদ সভা ও মিছিলে অংশ নেন। তীব্র প্রতিবাদ, ঘৃণা ও ক্ষোভে উচ্চকিত হয় শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হাইড পার্ক। সমাবেশটি আয়োজিত হয় “স্ট্যান্ড ফর রিলিজিয়াস মাইনরিটিস ইন বাংলাদেশ”-এর উদ্যোগে। 

কোভিড নিষেধাজ্ঞা ও সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন-কানুন মেনে আজ দুপুর ১২টায় প্রতিবাদকারীরা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, লিফলেট নিয়ে হাইড পার্কে সমবেত হন। সমাবেশ সমন্বয়কারী অমিত সাহা, অপু সাহা, সুরজিত রায়, ডঃ স্বপন পাল প্রমুখের নেতৃত্বে তারা সমাবেশস্থলে অবস্থান নেন। সভার শুরুতে এই নৃশংস হামলায় যারা নিহত হয়েছেন, এবং মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে উভয় দেশের প্রতি সম্মান জানান জ্যোতি বিশ্বাস ও বর্ণালী রায়। 

ডঃ স্বপন পাল ও অনন্যা ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায়, সভার শুরুতে বক্তৃতায় অস্ট্রেলিয়ান বেঙ্গলি হিন্দু এসোসিয়েশন (আভা)-র প্রতিনিধি, ডঃ সমীর সরকার এই ঘৃণ্যতম হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানান। সংখ্যালঘুদের প্রতিটি সরকারের বিদ্বেষ ও বৈষম্যের পরিসংখ্যান টেনে তিনি বলেন, দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুদের জমিকে “শত্রু সম্পত্তি” আইন করে তাদেরকে বঞ্চিত করেছে। এ কারণে হিন্দুরা প্রায় ২.৬ মিলিয়ন জমি ও অন্যান্য সম্পত্তি হারিয়েছে, যার আর্থিক মূল্য আনুমানিক ১৪০ বিলিয়ন ডলার, এবং ২০২১ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪০ ভাগ। এই আইনটি নতুন করে “অর্পিত সম্পত্তি” শিরোনাম দিলেও এর আসলেই কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বৈরী আচরণ ও অত্যাচারের কারণে বাংলাদেশ প্রায় আড়াই কোটি হিন্দু জনগোষ্ঠীও হারিয়েছে। সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করে বাংলাদেশকে ধর্মীয়ভাবে সহিষ্ণু একটি দেশে পরিণত করার আহ্বান জানান। নইলে বাংলাদেশেকে দ্বিতীয় আফগানিস্তান হওয়া থেকে কোনোভাবেই রক্ষা করা যাবে না।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট অজয় দাশগুপ্ত বলেন, “একাত্তরে আমরা সম্মিলিতভাবে দেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশটা কোনও একক গোষ্ঠীর নয়। গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগ এই জঙ্গী তৈরি করেছে। ভোটের দরকার নেই, তাই সংখ্যলঘুও নিগৃহীত”। তিনি আরও বলেন, “অনেকে প্রশ্ন করেন, আমরা আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে বিচার চাই কেন? এর কারণ, নাৎসিদের বিচার হয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালতেই। আর বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ নাৎসিদের কৃতকর্মের সাথে তুলনীয়। আমরা বাংলাদেশেকে ভালোবেসে এতদিন বলেছি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, কিন্তু এখন থেকে ‘আমি নয়নজলে ভাসি’ বলতে হবে”।

অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ফেডারেল ইমিগ্রেশন মন্ত্রী লরি ফারগুসন এই সমাবেশের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, “বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রতি এই সহিংসতা ও বৈষম্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এর অবসানের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিবিদ ও সরকারকে এই প্রতিবাদ ও সংগ্রামের সাথে যুক্ত করা প্রয়োজন”।  

সিডনির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরতলী প্যারামাটা-র লেবার দলীয় প্রতিনিধি দুর্গা ওয়েন বলেন “এটা বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য চরম দুঃখের ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া চলবে না। আপনাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের কাছে লিখিতভাবে জানান, সোশাল মিডিয়ায় প্রচার করুন। আমরা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে ও অন্যান্য সমাজে বিদ্যমান এই বৈষম্য ও অত্যাচার বন্ধ করব”। 

প্যারামটা-র প্রাক্তন কাউন্সিলর জেমস শঅ বলেন, “যে কোনও নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, একে রুখে দিতে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে আবেদন জানান”। 

মুহুর্মুহু স্লোগানের মধ্যে সভায় নিন্দা, ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ জানিয়ে এবং অনতিবিলম্বে সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে আরও বক্তব্য রাখেন, হিন্দু কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি সাই পরভাস্তু, ফিয়ান এর প্রতিনিধি যাদু সিং, মহাসঙ্ঘের প্রতিনিধি অরুণেশ শেঠ, কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের কাউন্সিলর সুমন সাহা, সিডনি বেঙ্গলি বুদ্ধিস্ট এসোসিয়েশনের নীতিশ বড়ুয়া, ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস হিন্দু স্টুডেন্ট সোসাইটির মৌমিতা পাল, আগমনী অস্ট্রেলিয়া-র কমলেশ চৌধুরী, অস্ট্রেলিয়ান ফোরাম ফর মাইনরিটিস ইন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি এবং প্যারামটার প্রাক্তন কাউন্সিলর প্রবীর মৈত্র, বাংলাদেশ পূজা এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া (বিপিএ)-এর দিলীপ দত্ত, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর পূজা এন্ড কালচার (বিএসপিসি)-এর অশোক রায়, জগন্নাথ হল এলামনাই এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি আশিস বরণ রায়, লোকনাথ ব্রহ্মচারী মিশন সিডনি-র পরমেশ ভট্টাচার্য, রাধাকৃষ্ণ গৌরীয় মন্দির-এর জ্যোতির্ময় বিশ্বাস এবং শঙ্খনাদ ইন্‌ক্‌-এর প্রতিনিধি অনুপম দেবরায়। 

সমাবেশের অন্যতম প্রধান সংগঠক সুরজিত রায় এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দেন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ন্যায্য অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন বেগবান রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। 

সভার শেষে অন্যতম সমন্বয়কারী অমল দত্ত, ইসলামী মৌলবাদীদের হামলার তীব্র নিন্দা করেন, এবং এই আন্দোলনের তীব্রতা সম্পর্কে সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দেন। তিনি নিম্নলিখিত ৯-দফা দাবি উত্থাপন করেন।

১.  হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের আশু সহায়তা, এবং এজাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে 

২. এই ঘটনার পূর্ণ, নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন তদন্ত করার জন্য একটি বিশেষ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে এই তদন্তের ফলাফল জনসমক্ষে উন্মোচিত করতে হবে  

৩. এই হামলাকারীদের সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে 

৪. হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সকলের বাড়িঘর, উপাসনালয় এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণ করতে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে 

৫. বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য একটি ভিন্ন মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে, যারা হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ আইন প্রণয়ন করবে 

৬. এ ধরনের হামলার পুনরাবৃত্তি রোধ করার উদ্দেশ্যে একটা বিশেষ আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে, যেখানে কমপক্ষে ৪০% সদস্য হিন্দু সম্প্রদায় থেকে নিতে হবে এবং বাকি সদস্যদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি উদার হতে হবে

৭. পুলিশ, গোয়েন্দা ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য হিন্দুদের সুরক্ষা দেবার কাজে নিয়োজিত ছিল, কিন্তু সে কাজে অবহেলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

৮. পাঠ্যক্রম সংস্কার করে, মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে এমন বিষয়বস্তু বাদ দিতে হবে, এবং এর বদলে সেইসব বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা আমাদের সমাজের সত্যিকার মূল্যবোধ তৈরিতে সাহায্য করে; এবং আমাদের প্রকৃত সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস তুলে ধরে

৯. ধর্মীয় সমাবেশে সকল প্রকার হিংসাত্মক বক্তব্য দেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে, এবং এর পরিবর্তে সহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় সম্প্রীতিবোধ জাগিয়ে তুলতে উৎসাহ দিতে হবে।

Post a Comment

0 Comments