জীবনে একবারই সুযোগ হয়েছিল চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে জন্মাষ্টমী মহোৎসব পূর্ব এক ধর্মসভায় প্রতিথযশা বক্তা প্রফেসর রনজিৎ চক্রবর্তী স্যারের বক্তব্য শুনার। অবাক লেগেছিল, জে এম সেন হলের মত একটা কোলাহলপূর্ণ জায়গায় যেখানে লোকে লোকারণ্য, সেখানে স্যার যখন বক্তব্য দিতে উঠলেন তখন একেবারে পিন পতন নিরবতা!
উনার বক্তব্যের পুরো ২৮ মিনিট সবাই একেবারে মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনেছে। শৈশব থেকেই বাবা জেঠাদের মুখে কতবার যে স্যারের ধর্মালোচনার সুখ্যাতি শুনেছি। এর আগে পরেও বিভিন্ন জায়গায় ভাল ভাল ধর্মীয় বক্তার আলোচনা শুনেছি বহুবার। তবে ইদানিং প্রায় জায়গায় আর ধর্মসভা হতে দেখা যায় না। এ সমস্ত আয়োজন মূলত কোন পূজা বা পার্বণ উপলক্ষে আয়োজিত মহোৎসবের আগের দিন হতো। অথচ এখনকার মহোৎসব যেন শুধু খিচুড়ি খাওয়া সর্বস্ব, মহোৎসবের অধিবাসের রাতে কয় তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া যাবে শুধু সে হিসাব করি, কোন কীর্তনীয়া দল কততে ভাড়া হলো এসব হিসাব করতে করতেই আয়োজন পেড়িয়ে যায়। মহানাম শ্রবণের মানুষও যেন শুধু আনন্দবাজারে মহাপ্রসাদ বিতরণের সময়ই বাড়ে। নিকট অতীতেও মানুষ কিন্তু ধর্মসভায় উপস্থিত হতো, কথা শুনতো, অনেকেই তা আত্মস্থও করতো।
এখন সব হারিয়ে যেতে বসেছে। কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, সরস্বতী পূজা, শিবপূজা, দোল পূর্ণিমা, উত্তরায়ণ, রাস, জন্মাষ্টমী, মন্দির/আশ্রমের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, গুরু মহারাজদের আবির্ভাব তিথি, তিরোধান তিথি ইত্যাদিতে বিভিন্ন প্রহরব্যাপী যে মহানামযজ্ঞ মহোৎসবের আয়োজন হয়, তাতে এখন প্রায় জায়গায় পূর্বের দিন কিছু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও, থাকে না ধর্মসভার আয়োজন। ব্যক্তিগত ভাবে ৪/৫ জায়গায় বিভিন্ন সময় আয়োজক কতৃপক্ষকে এ বিষয়ে জানতে চাইলেও কারো কোন আগ্রহ তেমন দেখিনি, বরং কিলোমিটার ব্যাপী আলোকসজ্জা, উচ্চমাত্রায় শব্দ দূষণে ভাল মানের সাউন্ড সিস্টেম, একান্ত ধর্মীয় আচারগুলোতেও যথাযথ মানুষের বাইরে যে যার সুবিধামত নানান ধরনের লোকদের অতিথি করার প্রবণতা, মূল আয়োজনের চেয়েও চাকচিক্যে দৃষ্টি নিবন্ধ অনেকেরই। হয়তো অনেকে অর্থ সামর্থ্যের কথা বলবে, কিন্তু এখনকার আয়োজনগুলোতে বাজেটের কোন কমতি নেই, সেটা দেখলেই বোঝা যায়। বলবে, এখন কি আর কেউ ধর্ম কথা শুনে? মানুষের সময়, প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- এসবকেও অযুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন অনেকেই।
কিন্তু আমরা কি আমাদের চর্চার জায়গায় ঠিক আছি? আমরা কি আমাদের আচার-ধর্ম এসব ধরে রাখতে পারছি? তাহলে কেন প্রযুক্তি বা ডিজিটাল মাধ্যমকে ঢাল করবো নিজেদের অনিচ্ছাকে আড়াল করতে? বরং এসবের ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা আমাদের সঠিক চর্চার জায়গা বা পরিসরটাকে আরও ব্যপ্ত করতে পারি সকলের মাঝে। যারা পালন করেন বা মানেন, এখনকার দিনে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যাদের স্মার্টফোনে কীর্তন, ধর্মীয় গান, ধর্মালোচনা-- এসবের অডিও বা ভিডিও নেই বা শুনেন না। ধর্মসভা বা সভা সমাবেশের বক্তব্যে কি হয় সেটা না ভেবে, কি হয় না সেটাই খুঁজে নেওয়া দরকার। স্বামীজীর শিকাগোর শহরের বক্তব্য ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
এ সময়ের নানান কুসংস্কার, অনাচার, ধর্মান্তরকরণ, অজ্ঞতা, মতবিরোধ দূরীকরণে, নিয়মিত বিরতির সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যৌক্তিক রুখে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে নিজেদের সঠিক জ্ঞানে গুণে চর্চায় গড়ে তুলতে এখনকার দিনেও উপলক্ষ ভিত্তিক 'ধর্মসভা' আয়োজনের কোন বিকল্প নেই। সূদুর অতীত থেকেই এই ধর্মসভা গুলোতে একদম প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সমাজের প্রতিটা স্তরের মানুষের একটা ইন্টারেকশন থাকে, মানুষ ভাবে, কথা বলে, অনেকে চর্চাও করে। ব্যক্তি নিজে ও পরিবার পরিজন ছাড়াও, এখানে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারতেন আমাদের বিভিন্ন মঠ-মন্দির-আশ্রমের পুরোহিত-গুরু মহারাজ'রা, যাদের সাথে প্রতিটা সাধারণ ভক্তবৃন্দের আন্তঃযোগাযোগ একেবারে প্রাত্যহিক এবং সকলেই তাদের ভক্তিভরে শ্রদ্ধা করেন, মানেন।
অনেক ক্ষেত্রেই উনাদের সেই ভূমিকায় দেখা যায় না কারণে বা অকারণে। একে অন্যের দোষারপে বা গুরুবাদী আলোচনা সমালোচনায় নয়, কুসংস্কার মুক্ত হতে, অনাচার রুখে দাঁড়াতে, সঠিক ধর্মচর্চায় মেরুদন্ড সোজা করে বুক চিতিয়ে শুদ্ধ সনাতনী হিসেবে গড়ে উঠতে প্রতিটা ধর্মীয় আয়োজনে সমাজ সংস্কারক শুদ্ধ সুবক্তাদের নিয়ে আয়োজন হোক ধর্মসভার, অন্ধকার কেটে সম্বৃদ্ধ হোক আমাদের চর্চা, সম্বৃদ্ধ হই আমরা, এমনটাই প্রত্যাশা
0 Comments