কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে মসজিদ-মাদ্রাসা

 

 - কিশোর চন্দ্র দাস

বাংলাদেশের দিনাজপুর-কাহারোল উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দিরের জমি দখল করে তৈরি হচ্ছে মসজিদ নির্মাণ। গত ১লা মার্চ দিনাজপুর-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাকারিয়া জাকা মসজিদ নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

কান্তজিউ মন্দিরটি 'কান্তজিউ মন্দির' বা 'কান্তজীর মন্দির' বা 'কান্তনগর মন্দির' নামে পরিচিত। মন্দিরটি বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলা কাহারোল উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত। কান্তজিউ মন্দিরটি মধ্যযুগীয় একটি হিন্দু মন্দির। মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রী রুক্মিণীকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করেন। এটির নির্মাণ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র রাজা রামনাথ রায়ের রাজত্বকালে শেষ হয়। মন্দিরটিতে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে মন্দিরটিতে বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে মন্দির প্রাঙ্গণে এক মাস ব্যাপী রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায় মহারাজা রামনাথ রায়ের সময়কাল থেকেই এই রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলা চলাকালীন সময় অনেক তীর্থ যাত্রী ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করেন। ২০১৭ সালের কলকাতা বইমেলায় বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসাবে বাংলাদেশ সরকার তাদের প্যাভিলিয়নটি কান্তজিউ মন্দিরের আদলে গড়েন।

কান্তজিউ মন্দির নির্মাণের সময় মহারাজা প্রাণনাথ পারস্য থেকে কিছু স্থপতি ও নির্মাণশিল্পী নিয়ে এসেছিলেন। প্রায় টানা ৪৮ বছর মন্দিরের নির্মাণকাজ অব্যাহত থাকে। আর নির্মাণশিল্পী ও শ্রমিকরা ছিলো মুসলমান ধর্মাবলম্বী। তারা মহারাজার কাছে নামাজ পরার জন্য অনুমতি নিয়ে কান্তজীর মন্দিরের ১কিলোমিটার দূরে নয়াবাদ নামক স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা বর্তমানে নয়াবাদ মসজিদ নামে পরিচিত।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে কান্তজিউ মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তিতে হঠাৎ করে দেখা যায় দুটি টিন-চাটাইয়ের ঘর ওঠে। সামনে বাঁশের খুঁটিতে একটি সাইনবোর্ড বসে। তাতে লেখা ‘শান্তিবাগ আল হেরা নূরানী তা’আলীমূল কুরআনা মাদ্রাসা’। ওই সময়ের দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট অমলেন্দু ভৌমিক জানান, বীরগঞ্জের মাকড়াই মৌজায় কান্তজিউ ঠাকুরের নামে মোট ১৬ দশমিক ৫৩ একর জমি রয়েছে। ৩৩ শতক জমিতে মাদ্রাসার ঘর তোলা হয়েছে। ওই সময়েরই বীরগঞ্জ কেন্দ্রীয় মহাশ্মশান উন্নয়ন কমিটির উপদেষ্টা মতিলাল দাস জানান, লক্ষ্মণ বুঝেই আমি গত ১৭ জানুয়ারি জিডি করি। তারপরও ঘর ওঠে, পুলিশও বাধা দেয়নি।

২০১৫ সালের ৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে ৩০০ বছর ধরে চলা রাসমেলায় তিনটি ককটেল বোমা ছোড়া হয়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। তিনজনের অবস্থা গুরুতর ছিল। হামলার পূর্বে মন্দিরের পুরোহিতকে কোন ধর্মীয় সমাবেশ না করার জন্য হুমকি দেয়া হয়। আমেরিকার প্রথম হিন্দু কংগ্রেস সদস্য তুলসী গ্যাবার্ড এই ঘটনার নিন্দা করেন। তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটকে মন্দিরে গিয়ে মন্দিরের অবস্থা দেখতে অনুরোধ করেন। এই হামলার সাথে জড়িত দুই জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট বইয়ের ১২ ও ১৩ নং পৃষ্ঠায় জলছাপে উজ্জল করে কান্তজিউ মন্দিরের ছবিটি ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০২২ সালের দিকে দেখা যায় পাসপোর্ট বইয়ের ১২ ও ১৩ নং পৃষ্ঠা থেকে কান্তজিউ মন্দিরের ছবিটি মুছে ফেলা হয়েছে।

বর্তমানে চলতি বছরের (২০২৪) ১লা মার্চ দিনাজপুর-কাহারোল উপজেলার কান্তনগর গ্রামের কান্তজিউ মন্দিরের রাজ দেবোত্তর এস্টেটের জমিতে মসজিদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ নেতা দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মো. জাকারিয়া জাকা। পরে গত ১৩ মার্চ নির্মাণকাজ বন্ধ চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন বর্তমান দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের এজেন্ট রণজিৎ কুমার সিংহ।

রণজিৎ কুমার সিংহ জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলেছেন "কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মৌজায় সিএস ২ নম্বর খতিয়ানটি শ্রীশ্রী কান্তজিউ বিগ্রহ পক্ষে সেবাইত অনারেবল মহারাজা জগদীশ নাথ রায় নামে প্রচারিত। ওই খতিয়ানে কান্তজিউ বিগ্রহর নামে ৯৪ দশমিক ০৭ একর জমি রয়েছে। এসএ ০৫ নম্বর খতিয়ানে দিনাজপুর রাজ দেবোত্তর এস্টেটের পক্ষে জিম্মাদার জেলা প্রশাসক ১৯টি দাগে ৬২ দশমিক ৪৬ একর জমি রয়েছে। বাংলা ১৪৩০ সন পর্যন্ত জমির খাজনা হালনাগাদ রয়েছে। গত ১০ মার্চ জানতে পারি যে, কান্তনগর মৌজার ১৬ নম্বর দাগে রাজ দেবোত্তর এস্টেটের সম্পত্তির ওপর একটি পাকা মসজিদ তৈরি করা হচ্ছে। এটা শুনে গত ১১ মার্চ নির্মাণাধীন মসজিদের জায়গাটি পরিদর্শন করি, দেখি মসজিদটি রাজ দেবোত্তর এস্টেটের কান্তনগর মৌজার এসএ ৫ নম্বর খতিয়ানের ১৬ নম্বর দাগের ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি মোজাম্মেল হকের কাছে কীভাবে রাজ দেবোত্তর এস্টেটের জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করছেন, জানতে চাইলে জানান, ১৯৭৬ সালে ডিসি দিনাজপুর ওই জমি তাদের দিয়েছেন। তার কাছে দলিল দেখতে চাইলে তিনি একটি হাতে লেখা তিন পৃষ্ঠার আপসনামার ফটোকপি দেন। কথিত আপসনামাটি যাচাই করে দেখি, উহা কোনো বরাদ্দ নয়। এটি কোনো রেজিস্ট্রিকৃত জমির দলিল নয়। ওই কাগজে মালিকানা হস্তান্তরের কোনো কথা উল্লেখ নেই। আপসনামাটি ভুয়া ও বানোয়াট মনে হয়। তা ছাড়া ১৯৯৯ সালের ৫১ ডিএলআর বলা হয়েছে, দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য নয়, উহা সব সময়ের জন্য দেবোত্তর সম্পত্তি।

সাবেক সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য গত ১ মার্চ সব জেনে-শুনেই সমজিদের নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মূলত তিনিই সমজিদ নির্মাণে সহযোগিতা করছেন। মসজিদের নির্মাণকাজ বন্ধে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। তিনি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি সমাধানে বসার কথা বলে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এদিকে মসজিদ নির্মাণকাজ এগিয়ে যাচ্ছে। নির্মাণ হয়ে গেলে তো স্থাপনা আর ভাঙা যাবে না। তাই যা কিছু করতে হয় আগেই করা উচিত।

এই বছরই (২০২৪) ২৯শে মার্চ রোজ শুক্রবার কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গনে বিশ হাজার কন্ঠে গীতা পাঠ করার কথা থাকলেও রমজান মাসের কারণে তারিখ পরিবর্তন করে ২০শে এপ্রিল রোজ শনিবার করতে বাধ্য হয় বিশ হাজার কন্ঠে গীতা পাঠের আয়োজক কমিটি।

দেখা যাচ্ছে কান্তজিউ মন্দির যেভাবে একের পর এক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে ভবিষতে এই মন্দিরের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে বাংলাদেশের হিন্দুদের।


 

Post a Comment

0 Comments